বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১১:০৭ অপরাহ্ন

মণিপুরে নারীদের নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও ঘিরে উত্তাল ভারত

মণিপুরে নারীদের নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও ঘিরে উত্তাল ভারত

স্বদেশ ডেস্ক:

ভারতের অগ্নিগর্ভ মণিপুরে দু’জন কুকি মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় নগ্ন করে ঘোরানোর সাম্প্রতিক একটি ভিডিও সামনে আসার পর সারা দেশ শোকে-দুঃখে-রাগে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। ওই দুজন নারীর অন্তত একজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলেও জানা যাচ্ছে।

প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে পার্লামেন্টে, আর সুপ্রিম কোর্ট বলেছে এই ‘চরম সাংবিধানিক ব্যর্থতা’র বিরুদ্ধে সরকার যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তারা নিজে থেকেই পদক্ষেপ নেবে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর আগে দেয়া এক ভাষণে বলেছেন, ওই দৃশ্য দেখে তাঁর হৃদয় দুঃখে ও ক্রোধে ফুঁসছে।

ওই ঘটনায় যারা দোষী, তাদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এদিন সকালে বলেছেন, “মণিপুরের দুহিতাদের সাথে যা ঘটেছে তা কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না।”

এর কিছুক্ষণ আগেই মণিপুর সঙ্কট নিয়ে মুখ না খোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে মন্তব্য করেন, “নরেন্দ্র মোদীজি, মণিপুর নিয়ে আপনার নীরবতার জন্য দেশ কিছুতেই আপনাকে ক্ষমা করবে না।”

পার্লামেন্টের অধিবেশনে আর সব কার্যক্রম স্থগিত করে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি আলোচনার জন্য বিরোধী দলের অন্তত ১৫ জন এমপি মুলতুবি প্রস্তাবও এনেছেন।

এদিকে মণিপুর পুলিশও স্বীকার করেছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওটি জাল নয় – সত্যি। তবে ওই ঘটনা গত ৪ মে তারিখের এবং তাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ, গণধর্ষণ ও হত্যার মামলাও হয়েছিল বলে তারা জানাচ্ছে।

আড়াই মাসেরও বেশি পুরনো ঘটনা হলেও এই মামলায় প্রথম গ্রেপ্তারের ঘটনাটি ঘটেছে অবশ্য গতকাল (বুধবার) রাতেই, ভিডিওটি কেউ বা কারা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়ার পরে।

মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছেন, এই ঘটনায় যারা দোষী, তারা যাতে ফাঁসির সাজা পায় তিনি সেই চেষ্টাই চালাবেন।

মণিপুরে সেদিন কী ঘটেছিল?
বুধবার থেকে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মণিপুরের রাস্তায় কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের দু’জন নারীকে নগ্ন করে একদল লোক রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের ক্রমাগত যৌন লাঞ্ছনা করা হচ্ছে।

দু’জন নারীর একজনের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি-বাইশ, অন্যজনের চল্লিশের আশেপাশে।

ভিডিওতে দেখা যায়, জনতার মধ্যে অনেকেই ওই নারীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ খামচে ধরছে। এরপর তাদের জোর করে একটি চাষের ক্ষেতের দিকে টেনে নিয়ে যেতেও দেখা যায়।

পরে ১৮ মে তারিখে ওই ঘটনার যে এফআইআর করা হয়েছে, তাতে ভিক্টিমরা অভিযোগ করেছেন তুলনায় কম বয়সী মেয়েটিকে প্রকাশ্য দিবালোকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছিল।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ঘটনার দিন কাংপোকপি জেলায় তাদের গ্রাম যখন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রাণে বাঁচতে তারা পরিবারের কয়েকজন মিলে কাছের জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

পথে থৌবাল জেলার একটি পুলিশ ভ্যান তাদের উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে নেয়। তবে পুলিশ যখন তাদের থানায় নিয়ে যাচ্ছিল, তখন থানা থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে একদল উত্তেজিত জনতা তাদের ঘিরে ধরে।

এফআইআরে উল্লেখ করা হয়েছে, “ওই ক্ষুব্ধ জনতা তাদের পুলিশের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”

কিন্তু ভিক্টিম দু’জন নারীর একজন গতকাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে জানিয়েছেন, “পুলিশ আসলে হামলাকারীদের সঙ্গেই ছিল। ওরা বাড়ির বেশ কাছেই প্রথমে আমাদের গাড়িতে তুলে নেয়, তারপর গ্রামের একটু বাইরে গিয়েই রাস্তায় ছেড়ে দেয়। পুলিশই ওই জনতার হাতে আমাদের তুলে দিয়েছিল।”

অর্থাৎ ওই ভিক্টিম দাবি করেছেন, পুলিশের কাছ থেকে তাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়নি – পুলিশই ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ওই হামলাকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে।

ওই জনতা এরপর জোর করে নারীদের সব জামাকাপড় খুলতে বাধ্য করে। তাদের রাস্তা দিয়ে নগ্ন করে হাঁটানো হয়, এরপর পাশের ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন চালানো হয়।

অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে, তিনজন নারী ও দুজন পুরুষ-সহ তারা দলে মোট পাঁচজন ছিলেন, যারা গ্রাম থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। বছর পঞ্চাশের যে তৃতীয় নারী ছিলেন, তাকেও নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল।

দলের দু’জন পুরুষ ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী নারীটির বাবা ও ভাই। ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় তাদের দুজনকেই হামলাকারীরা হত্যা করেছে বলেও এফআইআরে জানানো হয়েছে।

গত ৩রা মে থেকে মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেইতেই ও সংখ্যালঘু কুকিদের মধ্যে যে রক্তাক্ত জাতি-সংঘাত এবং অবাধ হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ শুরু হয়েছে, এই ঘটনা ছিল ঠিক তার দ্বিতীয় দিনেরই।

তবে এই ঘটনার বীভৎসতা ও নৃশংসতা ঠিক কতখানি ছিল, তা সারা দেশ জানতে পারল ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার আড়াই মাস পর।

ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায়
ঘটনাচক্রে আজ থেকেই সদ্য উদ্বোধন হওয়া দেশের নতুন পার্লামেন্টে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে, যেটি ওই ভবনে প্রথম সভা।

পার্লামেন্টের সভা বসার আগেই অবশ্য মণিপুরের ওই ভিডিও নিয়ে তুমুল হইচই পড়ে যায়, গতকাল বিকেলে অধিবেশনের আগে ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকেও যা নিয়ে অংশগ্রহণকারী এমপি-রা ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতেন না।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে ওই ভিডিও-টির প্রসঙ্গ টেনে টুইট করেন, “মণিপুরে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে আপনারা ‘মবোক্রেসি’তে পাল্টে ফেলছেন। তার পরেও আপনি মণিপুর নিয়ে চুপ – ভারত কিন্তু আপনাকে ক্ষমা করবে না।”

বিরোধ দলীয় এমপি-রাও এক সুরে দাবি জানাতে থাকনে, পার্লামেন্টে বাকি সব কাজ ফেলে অবিলম্বে মনিপুর নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।

এর একটু পরেই পার্লামেন্টের বাইরে অধিবেশন শুরুর আগে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশেষে মণিপুর নিয়ে তাঁর নীরবতা ভঙ্গ করেন। মণিপুরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর আশি দিনে প্রথমবার।

ওই ভাষণে পার্লামেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আজ আমি যখন গণতন্ত্রের মন্দিরের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে, আমার হৃদয় গভীর যন্ত্রণা আর ক্রোধে ভরে উঠেছে। মণিপুরের ঘটনা যে কোনও সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্ক – আমাদের গোটা দেশ এর জন্য লজ্জিত।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমি দেশকে কথা দিচ্ছি এই ঘটনায় দোষীরা কেউ পার পাবে না। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মণিপুরের দুহিতাদের সাথে যা ঘটেছে তা ক্ষমার অযোগ্য।”

এদিকে আজ ভারতের শীর্ষ আদালতও স্বত:প্রণোদিতভাবে মণিপুরের ওই ঘটনাটি ‘কগনিজেন্সে’ নিয়ে এটিকে ‘চরম সাংবিধানিক ব্যর্থতা’ বলে বর্ণনা করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, “গতকাল থেকে যে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি দেখে আমরা অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছি এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।”

সরকার আপনা থেকে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না-নিলে সুপ্রিম কোর্ট আগামী ২৮ জুলাই (শুক্রবার) থেকে নিজেরাই এই মামলার শুনানি শুরু করবে বলেও প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন।

সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপও সুপ্রিম কোর্টকে নিয়মিত অবহিত করতে হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ভারতের বলিউড তারকারাও অনেকেই মণিপুরের এই ভিডিও নিয়ে মুখ খুলেছেন এবং দোষীদের ‘অকল্পনীয়’ বা ‘কঠোরতম’ সাজা দাবি করছেন।

অভিনেত্রী কিয়ারা আডভানি টুইট করেছেন, “দ্য হরিফাইং ভিডিও শেকেন মি টু দ্য কোর!” বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমারও জানিয়েছেন, তিনি ‘শেকেন, ডিসগাস্টেড টু সি দ্য ভিডিও”!

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877